ক্লাসিক্যাল আরবী সাহিত্যে আবুল আতাহিয়া এক উজ্জ্বল নক্ষত্র। কবির আসল নাম ইসমাঈল ইবনুল কাসিম ইবনে সুয়াইদ। উপনাম আবু ইসহাক এবং উপাধি আবুল আতাহিয়া। তিনি তার উপাধিতেই অধিক পরিচিত। কবির মায়ের নাম উম্মে যায়েদ বিনতে যিয়াদ আল মাহারাবি, তিনি বনু যাহরা গোত্রের লোক ছিলেন। বৈরুত থেকে প্রকাশিত কবির কবিতা সংকলন “দিওয়ান-ই-আবুল আতাহিয়া” গ্রন্থে কবির উপাধি আবুল আতাহিয়া হওয়া নিয়ে দুটি মতামত পাওয়া যায়। যার মধ্যে প্রথম মতটি হল- আব্বাসি খলিফা মাহদি একবার কবিকে সম্বোধন করে বলেছিলেন-             انت إنسان متحذلق معته এরপর থেকে তার নাম আবুল আতাহিয়া নামে প্রসিদ্ধি লাভ করে। আর দ্বিতীয় মতটি হল মাহদি বিন ইহায়ইয়া এর। তিনি বলেন-
كني بأبي العتاهية إذ كان يحب الشهرة والمجنون والتعته
কবির জন্ম ১৩০ হিজরি মোতাবেক ৭৪৮ খ্রিঃ হিজাযের অন্তর্গত আয়নুত তামার নামক স্থানে। সেখানেই কবির শৈশব কাটে। শৈশবে কবি পারিবারিক পেশা কুমোর এর কাজ করতেন। মৃৎ শিল্পে নানা জিনিস তৈরি করে তা কুফার গলিতে গলিতে বিক্রি করতেন।

ছোটবেলা থেকেই সাহিত্য, বিশেষত কবিতার প্রতি তার ঝোঁক ছিল প্রবল।ফলে তিনি কবিতা রচনা করেতন স্বভাবগত ভাবেই। এজন্য আবুল আতাহিয়ার অনেক কবিতাই অলংকার শাস্ত্রের বিধিবদ্ধ ছন্দের আওতাও এ পড়েনা। ইবনে কোতায়বা তার      الشعر والشعراءবইয়ে বলেন আতাহিয়ার কবিতা নিয়ে বলতে গিয়ে এরকমটাই বলেছেন। 

আব্বাসী যুগের বিখ্যাত কবি আবু নূয়াস, বাশশার বিন বুরদ ও আবু তাম্মাম প্রমুখ কবিদের সমপর্যায়ের কবি ছিলেন আবুল আতাহিয়া। শরাবকাব্য বা খামরিয়্যাতের কবি আবু নুয়াসের সাথে আবুল আতাহিয়ার ছিল গভীর সখ্য।  

আবুল আতাহিয়ার কবিতার ভাষা সহজবোধ্য হওয়ায় তার সময়ের অন্য কবিদের তুলনায় তার কবিতা অধিক পাঠকপ্রিয়তা পেয়েছিল। কবি তার লেখক জীবনের প্রথম দিকে সমসাময়িক অন্য কবিদের মতই তৎকালীন প্রচলিত বিষয় পার্থিবতা নিয়েই কবিতা লিখতেন। আব্বাসী খলিফা মাহদীর দাসী আতবা কর্তৃক প্রেমে প্রত্যাখ্যাত হয়ে কবি পার্থিবতাবিমুখ কবিতা লেখা শুরু করেনপরবর্তিতে যুহদিয়্যাত-ই আবুল আতাহিয়ার নাম আরবী কাব্য সাহিত্যে অবিস্মরনীয় কোড়ে তোলে।

আবুল আতাহিয়া এমন সময় যুহদিয়্যাত লেখা শুরু করেন যখন আরবী ভাষায় আজ্রাদ (মৃ১৬১ হিঃ), ওয়ালিবা বিন হুবাব (মৃ ১৭০ হিঃ), মুতি ইবনে ইয়াস (মৃ ১৬৬ হিঃ) প্রমুখদের মত কবিরা তাদের কবিতায় মানুষকে ভোগ বিলাসীতায় মত্ত থাকার আহ্বান জানাতেন। সেই সময়ে আবুল আতাহিয়া তার যুহদিয়্যাতের মাধ্যমে মানুষের মনে সৃষ্টিকর্তার ভয় ও তার আনুগত্যের কথা স্মরণ করিয়ে দেন। ধর্মীয় ভাবাবেগ সম্পন্ন এসব কবিতা দ্রুতই সমাজের আলোড়ন তুলে এবং মানুষের মুখে মুখে আবৃত্তি হতে থাকে। যুহদিয়্যাতের জন্য বিখ্যাত এ কবি খলিফা মামুনের শাসনামলে ২১০হিজরি মতান্তরে ২১১হিজরিতে ইন্তেকাল করেন। তাকে বাগদাদে দাফন করা হয়।

যুহদিয়্যাত

কবি আবুল আতাহিয়া তার যুহদিয়্যাত কাব্যে তৎকালীন আরবী কাব্যের প্রথা বিরোধী পথে হেটেছেন। আব্বাসী যুগে সাহিত্যের নতুন নতুন শাখা সৃষ্টি হয়। এ সময় ভিন্ন ভিন্ন ভাষা ও সাহিত্যের সাথে আরবী সাহিত্যের ব্যাপক পরিচিতি ঘটে। এ সময়ের কবিদের চর্চিত কাব্যধারার বিপরীতে সহজ সাবলীল ভাষার যুহদিয়্যাত মানুষের মাঝে ব্যাপক সাড়া ফেলে।
যুহদিয়্যাত কাব্য ছিল মূলত পৃথিবীর প্রতি আকর্ষণ হারিয়ে ফেলা এক ব্যক্তির পৃথিবী নিয়ে পর্যবেক্ষণআর তার এ পর্যবেক্ষণ ইসলামী জীবনধারার সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ হওয়ায় এর আবেদন কালোজ থেকে কালোত্তর হয়ে উঠেছে; ভাষার সহজবোধ্যতা এর আরেকটি অন্যতম কারণ। 

কবি তার যুহদিয়্যাতে নিজেকে সবচেয়ে বড় পাপী হিসেবে অভিহিত করে আল্লাহর কাছে শাস্তি মোচনের প্রার্থনা করেছেন। নিজেকে পাপী মনে নিজের পাপের অনুশোচনা ও তার জন্য আল্লাহর ক্ষমা প্রার্থনা ইসলামের মহান শিক্ষা; কবির কলমে সে শিক্ষাই সুন্দরভাবে ফুটে উঠেছে। কবির ভাষায়-                 

إلهي لاتعذّبني فإنّي٭مقرّ بالّذي قد كان منّي
কি সুন্দর! কি সরল স্বীকারোক্তি, কত অমায়িক ক্ষমাপ্রার্থনা। মানুষ যতই পাপ করুক, আল্লাহ মেহেরবান। সে আল্লাহর কাছে পাপ স্বীকার করে ক্ষমা চাইলে আল্লাহ তার বান্দাকে ক্ষমা থেকে কখনো নিরাশ করেন না। আর তার দরজা ছাড়া মানুষের আর কোন পথও নেই ক্ষমা পাবার। কবিতার পরবর্তী লাইনে কবি সে কথাই সুন্দরে ফুটিয়ে তুলেছেন। কবির ভাষায়- 
فمالي حيلةإلّارجائ٭لعفوك إن عفوت وحسن ظنّي
وكم من زلّةلي في البرايا٭وأنت عليّ ذو فضل و منّ
ক্ষণস্থায়ী এ পৃথিবীর মায়ায় পড়ে, এর মোহে মানুষ তার সৃষ্টিকর্তাকে ভুলে পার্থিবতায় মত্ত। একদিন সবকিছু যে শেষ মানুষ সে কথা ভুলে যায়। কবি মানুষকে সে কথাই স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন
ألا إنّناكلّنا بائد٭ وأيّ بني أدم خال
 আমরা সবাই ধ্বংস হয়ে যাব, এ কথা বলার পরই কবি মানুষের সন্দিগ্ন মনকে প্রশ্ন করছেন; এমন কোন আদম সন্তান আছে যে চিরজীবি হবে! পরের লাইনে এসেই কবি মানুষের শুরু এবং শেষ কোথায় তা স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন-
ويدؤهم كان من ربّهم٭ وكلّ إلى ربّه عائد



মানুষ এসব জানার পরও কিভাবে সৃষ্টিকর্তার অবাধ্য হয় তা কবির কাছে বিস্ময়ের। বিচারের দিনে মানুষের বিরুদ্ধে তার সবকিছু সাক্ষী দিবে কবি মানুষকে তা মনে করিয়ে দিচ্ছেনকবির কথায়-


فياعجبا! كيف يعص الإله؟ ٭ أم كيف يجحده الجاحد؟!
واللّٰه في كلّ تحريكة٭ علينا و تسكينة شاهد 


আবুল আতাহিয়ার যুহদিয়্যাত মানুষকে তার প্রভুর কথা স্মরণ করানোর কাজই করেছেন নিরন্তর। মানুষকে পার্থিব মোহমুক্ত করার কথাই নিরন্তর বলে যায় যুহদিয়্যাত। পৃথিবীর জীবনে ক্ষণস্থায়ীত্ব বারবার মনে করিয়ে দেয় যুহদিয়্যাত। পৃথিবী ছেড়ে গেলেই সব শেষ হয়ে যাবে, মিশে যাবে সব মাটিতে। কবির বর্ণনায়-
ما لي مررت علي القبور مسلما ٭ قبر الحبيب، فلم يردّ جوابي
لو كانا ينطق بالجواب لقال لي: ٭ اكل التّراب محاسني و شبابي 


মানব জীবনের শৌর্যবীর্যের অমোঘ পরিণতির কথা এভাবেই সুন্দরভাবে যুহদিয়্যাতে তুলে ধরেছেন আবুল আতাহিয়া। এই পরিস্থিতিতে পৌছার আগেই মৃত্যু পরবর্তী জবাবদিহিতার কথা মানুষকে স্মরণ করিয়ে তার প্রস্তুতি নিতে আহ্বান করছেন আবুল আতাহিয়া। কবি বলছেন-

فلو أنّا، إذامثنا، تُركنا، ٭ لكان الموت راحة كلّ حيِّ
ولكنا إذا متنا بُعثنا، ٭ ونُسأل بعد كلّ شيِّ 
  

আবুল আতাহিয়া তার যুহদিয়্যাতের প্রতিটি কবিতায়ই মানুষকে সৃষ্টিকর্তার দিকে আহ্বান, পরকালের প্রস্তুতি নেয়া, সৎকর্ম করা, দুনিয়ার  মোহে না পড়া ইদ্যাতি নিয়েই আলোচনা করেছেন।
আবুল আতাহিয়ার যুহদিয়্যাতের কাব্যগুলো সৃষ্টিকর্তার আনুগত্য প্রকাশের আহবানের অনন্য নজির।




Post a Comment

 
Top