আজ তেরোতম সকাল গৃহান্তরীণের। একবিংশ শতাব্দীর সভত্যা ও বিজ্ঞানের এই অত্যাধুনিক সময়ে বলতে গেলে পৃথিবীর সবাইকে (প্রায়) অদৃশ্য এক শত্রুর ভয়ে স্বেচ্ছায় নিজ গৃহে বন্দী থাকতে হবে একথা কেউ ভাবেনি কখনো। ঢাকা থেকে ফিরেছি চলতি মাসের ১৯তারিখ সকালবেলা। এসেই গৃহান্তরে, আর কোথাও বের হওয়া হয়নি। গৃহবন্দিত্বের ছুটি আর সাধারণ ছুটিতে যে এত ফারাক তা এবার গৃহবন্দি না হলে বুঝতাম না। গৃহান্তরীণের দিনগুলোতে বাসার ছোটোবড়ো সবাইকে হাঁপিয়ে উঠতে দেখছি। সবার মাঝে কেমন যেন দমবন্ধ হওয়ার অবস্থা। তবুও কেউ বাহিরে যাওয়ার সাহস করছেনা। দুদিন থেকে মনে হচ্ছিল এসব দিনের কথা স্মৃতি থেকে যাতে না হারায় সেইজন্য লিখে রাখা দরকার।
একসময় দিনলিপি লেখা হত নিয়মিত। তখন নিম্ন মাধ্যমিকে পড়ি, সে দিনগুলোর আবেগ ভরা লেখা জমা পড়ে আছে ডায়রির পাতায়। জানিনা ডায়রিটা অক্ষত আছে কি না। গ্রামের বাড়ি ছেড়ে আসি চার বছর চলে, আগে মাঝেমধ্যে যাওয়া হলেও ইদানীং তা একেবারেই হচ্ছেনা। আমার বিশাল ক্যাবিনেট টেবিলের প্রথম ড্রয়ারে তালাবন্ধ ডায়রিটা কেমন আছে কে জানে!
স্নাতক জীবনের সর্বসাকুল্যে ৩/৪দিন দিনলিপি লিখেছি, দিনলিপি লেখাটা আসলে অনেকটা ইতিহাস রচনার মতো। তবে এখানে মজার বিষয় হলো, ইতিহাস রচনা করতে গেলে অনেক তথ্য-উপাত্তের প্রয়োজন হয়, দিনলিপিতে তা দরকার পড়েনা। তবে দিনলিপিকে বোধহয় পুরোপুরি ইতিহাস না বলে ইতিহাসের অংশ বলাই শ্রেয়। এখানে আরেকটি জিনিস আমার খুব উপকারী মনে হয়, আর তা হচ্ছে- দিনলিপিতে কেউই রঙ চড়ায় না যেটা অনেক ইতিহাসবেত্তা ইতিহাস রচনায় করে থাকেন। কারণ দিনলিপি সাধারণত মানুষ শুধু তার স্মৃতি জমানোর উদ্দেশ্যেই লিখে থাকে। সেদিক থেকে দিনলিপি ইতিহাসের নির্ভরযোগ্য দলিল হয়ে উঠে।
সাহিত্যের ছাত্রদের এই এক মধুর সমস্যা, একটা বিষয় নিয়ে লিখতে গিয়ে প্রসঙ্গান্তর করে প্রাসঙ্গিক আরো অনেক আলোচনা নিয়ে আসা। অল্পবিস্তর যে কয়দিন দিনলিপি লিখতে বসেছি আমিও তা থেকে মুক্ত থাকতে পারিনি। দিনলিপির এসব বিষয় নিয়ে লিখতে মনে পড়ছে আনা ফ্রাঙ্ক এর কথা। মাত্র তেরো বছরের একটি মেয়ে, সে কি জানতো তার নিষ্পাপ দিনলিপি একদিন বিশ্বের মানুষের কাছে এত পরিচিত হবে! হয়ে উঠবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের নির্মমতার এক করুণ সাক্ষী। এখানে খুবই মজার একটি বিষয় হচ্ছে কাগজ কলম যে মানুষের কত আপন তা বন্দিত্ব ছাড়া ভালো করে উপলব্ধি করা হয়না। এরকম দু-তিনটে বিখ্যাত দিনলিপির কথা মনে পড়ছে,
১, আনা ফ্রাঙ্ক তার দিনলিপিটা লিখেছিল বিশ্বযুদ্ধের বিভীষিকায় পালিয়ে বেড়ানো আর আত্মগোপনের দিনে। তেরো বছরের মেয়েটির সে বিষাদের দিনে একমাত্র আপন, প্রাণখোলে কথা বলার সাথী হয়েছিল তার জন্মদিনে উপহার পাওয়া সেই লাল ডায়রিটা। কাগজ মানুষের থেকেও যে অনেক বেশি আপন হয়ে উঠে এই কথাটি লিখে গিয়েছে তেরো বছরের কিশোরী আনা ফ্রাঙ্ক। আজ তার ডায়রিটা বিশ্বখ্যাত হয়ে আছে।
২, আমাদের জাতির জনক, স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান গণমানুষের অধিকার নিয়ে কথা বলতে গিয়ে তাঁর জীবনের অধিকাংশ সময় জেলের ভিতর কাটিয়েছেন। তাঁর সহধর্মিণী, মহিয়সী নারী বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেসার অনুরোধে কারাগারে বসেই শুরু করেছিলেন দিনলিপি লেখা, যার ফল আজকে 'অসমাপ্ত আত্মজীবনী' ও 'কারাগারের রোজনামচা' নামে আমাদের সামনে। আমরা এর মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুকে আরো কাছে থেকে জানা এবং ঐ সময়ের অনেক না জানা ইতিহাস জানতে পারছি। এইক্ষেত্রেও দেখা যাচ্ছে জেলজীবনের একাকী সময়ে বঙ্গবন্ধুর সাথী হয়ে উঠেছিল কাগজকলম।
৩, বাঙালীর চরম কষ্ট ও একইসাথে গৌরবময় দিন হচ্ছে ১৯৭১ এর মুক্তিযুদ্ধের সময়কাল। জাতির সে দুর্দিনে একজন নারী ঢাকায় তার বাসায় বসে নিজের চারপাশের অবস্থার বিবরণ তার ডায়রিতে লিপিবদ্ধ করে চলেছেন। তার তরুণ ছেলে ও তার বন্ধুরা মুক্তিবাহিনীতে যোগ দিল, তার ছেলেটি মাত্র ক'দিন আগেই আমেরিকান এক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্কলারশিপ পেয়েছে। সেসব ভুলে সে তার দেশমাতৃকার ডাকে সাড়া দিয়ে নাম লেখালো গেরিলা যোদ্ধার দলে। ছেলে যুদ্ধে শহীদ হলো, ঐদিকে মা তার ডায়েরি লেখেই যাচ্ছেন। যুদ্ধ শেষ হলো, দেশ স্বাধীন হলো। কিন্তু মায়ের ছেলে আর ফিরে আসলো না। মা তার ছেলে আর ডায়েরির কল্যাণে হয়ে উঠলেন হাজার ছেলের মা, তিনি হয়ে গেলেন ''শহীদ জননী"। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে আমাদের লাখো যোদ্ধা শহীদ হলেও এই মা তার 'একাত্তরের দিনলিপি' দিয়ে সবার কাছে আলাদা পরিচয়ে স্বীকৃত। এইক্ষেত্রেও ডায়েরিটা দুর্দিনে লেখা।
যাই হোক, দিনগুলো বিরক্তি, উদ্বেগ আর উৎকণ্ঠার মধ্য দিয়েই যাচ্ছে। এই বাধ্যতামূলক সঙ্গরোধের দিনগুলোতে প্রাপ্তি হচ্ছে পরিবারের সবার একসাথে সময় কাটানো। আমাদের সমাজ থেকে এটি প্রায় উঠেই যাচ্ছিল। ছোটদের সাথে আজকাল কেউ বসার সময়ই পায়না। করোনার দিনগুলো সে সুযোগ করে দিয়েছে। আমিও আপু, ভাগ্নেদের সাথে লুডো খেলে সময় পার করছি। মাঝেমাঝে কিছু পড়াশোনাও হচ্ছে।
মার্চ ৩১, ২০২০
শাহজালাল উপশহর, সিলেট।